বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ের কিছু সিদ্ধান্তে আপোষকামিতার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে বলে সমালোচকরা মনে করছেন। অথচ ইতিহাস আমাদের শেখায়—এই দলের বহু সিনিয়র নেতা ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়েই মৃত্যুদণ্ড মেনে নিয়েছেন। তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন আদর্শ রক্ষায়, আপোষহীনতায়। এটাই ছিল “আজিমত”-এর উপর আমল। তাদের রক্ত ও ত্যাগের ফসলেই আজ দল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্ভাবনার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু বর্তমানে নীতিনির্ধারণে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা অনেককে হতাশ করেছে। দলকে সামনে এগোতে হলে এই আপোষকামী ধারা থেকে বের হয়ে আবারও সেই তাকওয়া, পরহেজগারি ও আদর্শিক দৃঢ়তার জায়গায় ফিরে যাওয়া জরুরি।
সাংগঠনিক কাঠামোতে নতুন ভাবনা
রাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণভিত্তিক করতে সংসদের মতো উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে।
উচ্চকক্ষ: জামায়াতের মৌলিক আদর্শ, নীতি ও শরীয়াহ্ ভিত্তিক দিকনির্দেশনা রক্ষার কেন্দ্র।
নিম্নকক্ষ: এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে ভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আসা, বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন—শর্ত হচ্ছে তারা যেন জামায়াতের মৌলিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করেন।
এমন কাঠামো হলে একদিকে আদর্শের শুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ থাকবে, অন্যদিকে জনগণের বৃহত্তর অংশকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে একটি বাস্তবধর্মী রাজনৈতিক শক্তি তৈরি হবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির অপরিহার্যতা
একটি দল যদি মনে করে—শুধু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা শ্রেণির উপর ভর করেই রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছানো সম্ভব, তবে সেটা হবে ভুল চিন্তা।
“কোন একটা ছোট গোষ্ঠী বা কাউকে বাদ দিয়ে, কারো সুস্থ অবস্থানকে মূল্যায়ন না করে ক্ষমতায় যাওয়া কখনো সম্ভব হবে না।”
তাই দরকার প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে, ভিন্নমত ও ভিন্নধর্মের জনগণকে ন্যায্যভাবে জায়গা দেয়া, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা, এবং নীতি-আদর্শের কাঠামোর মধ্যে থেকে অন্তর্ভুক্ত করা। তবেই জনগণের আস্থা তৈরি হবে, এবং জনগণের জোয়ার সৃষ্টি হবে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা
তুরস্কে এরদোয়ান কিংবা সুদানে ইসলামপন্থী দলগুলো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও পূর্ণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কেন? কারণ জনগণের অন্তর্ভুক্তি ও নীতি-আদর্শের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশের জন্য তাই অন্ধ অনুসরণ নয়, বরং শরীয়তের আলোকে গবেষণালব্ধ নীতি-নির্ধারণ অপরিহার্য।
নেতৃত্ব বাছাইয়ের মানদণ্ড
ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস প্রমাণ করে—শুধু জাগতিক যোগ্যতা নয়, বরং তাকওয়া ও নৈতিকতা নেতৃত্ব নির্বাচনের মূল শর্ত। কারণ ক্ষমতায় বসানোর মালিক আল্লাহ, আবার ক্ষমতা থেকে চ্যুত করার মালিকও আল্লাহ। দল যদি ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রাখে, তবে সেই দলই জনগণের কাছে আস্থাভাজন হয়ে ওঠে।
জামায়াতের নেতাকর্মীদের মনে রাখতে হবে—ক্ষমতায় যাওয়ার পথ কেবল কৌশল নয়, এটি একটি নৈতিক যাত্রা। আদর্শের সাথে আপোষ না করে, তাকওয়া ও ন্যায়ভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তুলে, এবং সর্বস্তরের জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব।
লেখক :
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোঃ কামাল উদ্দিন চৌধুরী